ইসরায়েলের সঙ্গে টানা ১২ দিনের সংঘাতের অবসানের পর ইরানে এখন এক ব্যতিক্রমী জাতীয় ঐক্যের চিত্র তুলে ধরছে দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বন্দীদেরও যুদ্ধকালীন ধৈর্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঐক্যের আড়ালে রয়েছে এক গভীর অস্থির সম্ভাবনা।
ইরান ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান সরাসরি স্বীকার করেছেন যে, যুদ্ধ চলাকালে সরকার জনগণকে সুরক্ষা দিতে পুরোপুরি সফল হয়নি। এরপরও জনগণ রাস্তায় নামেনি বা বিদ্রোহ করেনি—এটিকে তিনি ‘অভূতপূর্ব সংযম’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
তবে ইরান সমাজবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি সাঈদ মোইদফার সতর্ক করে বলেন, “যদি এই মুহূর্তে সরকার জনমানুষের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচাতে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়, তাহলে যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে না; বরং তা আরও বড় সামাজিক সংকটের সূচনা ঘটাতে পারে।”
আরও পড়ুন
আলোচনায় একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে—ইরানের শাসকগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোর ভাষায় ধর্মীয় মতাদর্শের পরিবর্তে এখন জাতীয় পরিচয়ের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রের শিরোনামে ‘ইরান’ শব্দটি গুরুত্ব পাচ্ছে, যেখানে ‘ইসলাম’ শব্দটি অনেকাংশে অনুপস্থিত। এমনকি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সাম্প্রতিক ভাষণেও ‘ইসলামিক ইরান’ শব্দবন্ধটি মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে, সেটিও প্রসঙ্গহীনভাবে।
তেহরানের আজাদি মনুমেন্টের নিচে ‘ও ইরান’ দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন এবং সংস্কৃতিমনা নাগরিকদের অভিনন্দন জানানোর আয়োজন প্রমাণ করে, সরকারের পক্ষ থেকে এখন এক ধরনের দায়বোধ কাজ করছে। সমাজবিজ্ঞানী হামিদ রেজা জালাইপুর বলেন, “এই মুহূর্তে সরকারকে জনগণের সহনশীলতার প্রতিদান দিতে হবে, যাতে জাতীয় ঐক্য বাস্তব ভিত্তি পায়।”
এদিকে সংসদও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় নতুন কৌশল নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। জাতিসংঘের পারমাণবিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিতের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্যরা অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দাবি তুলেছেন এবং কিছু সদস্য সরকারবিরোধীদের সঙ্গে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে রাজনৈতিক আলোচনার প্রায় সব স্তরেই অনুপস্থিত একটি নাম—আয়াতুল্লাহ খামেনি। যিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং নীতিগত দিকনির্দেশনার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু। এখন দেখার বিষয়, শাসকগোষ্ঠীর ‘জাতীয় ঐক্য ও পরিচয়’ নির্ভর ভাষ্য কতদিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে পারে, নাকি এটি কেবল যুদ্ধপরবর্তী সাময়িক কৌশলেই সীমাবদ্ধ থাকবে।