১৯৬৭ সালের ৫ জুন, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রথম দিনেই ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো একে একে আরব দেশগুলোর বিমানঘাঁটিতে হামলা শুরু করে। জর্ডানের মাফরাক ঘাঁটিও ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য। মিশরের বিমানঘাঁটিতে ভয়াবহ হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল ২০০-র বেশি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে। কিন্তু জর্ডানের মাফরাকে ধ্বংস করার আগেই পাল্টা আঘাত হানে এক বাঙালি পাইলট — ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আজম।
তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত সাইফুল আজম ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধেও একাধিক সাহসী অভিযানে অংশ নেন এবং একটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার জন্য ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক পান। ১৯৬৬ সালে তিনি জর্ডান বিমান বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তিনি জর্ডান ও ইরাকের হয়ে লড়েন এবং ইসরায়েলের চারটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেন।
আরও পড়ুন
৫ জুন মাফরাক বিমানঘাঁটিতে হামলার সময় সাইফুল আজম ও লেফটেন্যান্ট এহসান শারদুম মিলে একটি ইসরায়েলি ‘মিস্টেয়ার’ বিমান ধ্বংস করেন। পরে ইরাকের এইচ-থ্রি বিমানঘাঁটিতে তিনি আরও দুটি ইসরায়েলি বিমান গুলি করে নামান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং এই সফলতা তাঁকে এক ব্যতিক্রমী বীরের মর্যাদা দেয়।
ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে গিয়ে সাইফুলের সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও কৌশলী চালনার নিদর্শন আজও সামরিক ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি বিমানের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন এবং শত্রু বিমানের গতিপথ চিনে আঘাত হেনেছিলেন নিখুঁতভাবে।
এ সবকিছুর পর, জর্ডান, ইরাক ও পাকিস্তান সরকার তাঁকে বিভিন্ন সামরিক সম্মানে ভূষিত করে। জর্ডান ‘উইসাম আল-ইসতিকলাল’, ইরাক ‘নুত আল-সুজাত’ এবং পাকিস্তান ‘সিতারা-ই-বাসালাত’ পদকে সম্মানিত করে তাকে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
২০০১ সালে সাইফুল আজমকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘লিভিং ঈগল’ উপাধিতে ভূষিত করে ইন্টারন্যাশনাল হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অবসর গ্রহণের পর তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
তার মৃত্যু ২০২০ সালের জুন মাসে হলেও তাঁর কীর্তি আজও বাংলাদেশ, আরব বিশ্ব এমনকি ইসরায়েলেও স্মরণ করা হয়। ইসরায়েলি এক পাইলট জানান, তিনি যখন প্যারাসুটে ভেসে নিচে নামছিলেন, তখন সাইফুল আজম পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে তাকে হাত নেড়ে সম্মান জানান। এই ঘটনা শুধু এক বাঙালি পাইলটের সাহসিকতাই নয়, মানবিকতাও তুলে ধরে — যা যুদ্ধের নিষ্ঠুরতার মাঝেও আলো হয়ে জ্বলে।