২০২৪ সালের ‘জুলাই আন্দোলন’ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থবিরতা থেকে টেনে তুলে একটি নতুন গতির দিশা দেখিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের নানামুখী পদক্ষেপে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, রফতানি আয় এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কিছুটা স্বস্তি পেলেও বিনিয়োগ ও ব্যাংক খাত এখনও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে সরকারের তৎপরতায় দেখা দিয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। প্রবাসীদের জন্য রেমিট্যান্স প্রণোদনা ২.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করায় এবং হুন্ডি বন্ধে কঠোর অভিযান চালানোয় রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এর ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.৬৮ বিলিয়ন ডলারে, যা বছরের শুরুতে ছিল ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে।
রিজার্ভ বাড়ার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে ডলারের মূল্য কিছুটা কমায় দেশের মুদ্রাবাজারে স্বস্তি ফিরে আসে। ব্যাংকগুলো এখন সহজেই এলসি নিষ্পত্তি করতে পারছে এবং বর্তমানে ডলারের ক্রয়দর নেমে এসেছে ১২২.৭০ টাকায়, যা আগের তুলনায় অনেকটাই সহনীয়।
আরও পড়ুন
রফতানি খাতেও দেখা গেছে দৃশ্যমান উন্নতি। বিদায়ী অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বেশি। এ আয়রে প্রধান অংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে, বিশেষ করে নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাক থেকে যথাক্রমে ২১.১৬ ও ১৮.১৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভোগ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে সরকারের নীতিগত হস্তক্ষেপ—যেমন আমদানি শুল্কে ছাড়, টিসিবির কার্যক্রম বাড়ানো এবং মনিটরিং জোরদার—মূল্যস্ফীতিতে ভারসাম্য আনে। জুন ২০২৫-এ সার্বিক মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কমে ৭.৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
কর ব্যবস্থাপনায়ও এসেছে বড় পরিবর্তন। এনবিআর ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে করদাতাদের জন্য সহজ ও স্বচ্ছ সেবা নিশ্চিত করছে। ‘a‑Chalan’ চালু হওয়ায় কর পরিশোধ এখন ২৪ ঘণ্টা সম্ভব হচ্ছে, পাশাপাশি অনলাইন রিটার্ন দাখিল, কাস্টমস অটোমেশন ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা তৈরি হয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি এখনো চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংক খাত সংস্কারে নিয়োগপ্রাপ্ত গভর্নরের নেতৃত্বে নেয়া হয়েছে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ—দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ, অর্থপাচার তদন্ত, একক বিনিময় হার চালু, শাসন কাঠামো শক্তিশালীকরণ ও নতুন আইনি কাঠামো প্রণয়ন। ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি পদ্ধতি চালু হওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন আলাদাভাবে মূল্যায়নের সুযোগ পাচ্ছে, যা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনবে।
তবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এখনও ৭ শতাংশের নিচে রয়েছে, যা কাঙ্ক্ষিত ৯.৮ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং ঋণখেলাপির পরিমাণ ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরছে না। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।