মাত্র ৯ বছর বয়সী শাহিনা আক্তারের (ছদ্মনাম) কণ্ঠে ফুটে ওঠে তার জীবনের কঠিন বাস্তবতা—”মা তো কামে গেছে, রাইতে আইব। বাবা আমাদের ছাইড়া গেছেন। আমরা এখন গ্রামের বাড়িত থাকি না।” শাহিনার মা সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন পরিবারের স্বচ্ছলতার আশায়। কিন্তু ফিরে এসেছেন নিপীড়নের যন্ত্রণাসমেত এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। বর্তমানে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিতে নিজ পরিবারেই তিনি পরিত্যক্ত।
সাতক্ষীরার এই নারী এখন একটি গার্মেন্টসে কাজ করে সন্তানদের নিয়ে সংগ্রামী জীবনযাপন করছেন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া নারীদের বড় একটি অংশ শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। দেশে ফিরে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আরেক যুদ্ধ—পরিবার ও সমাজের অবহেলা।
ঝিনাইদহের তৃণা বিশ্বাস (ছদ্মনাম) সৌদি আরবে গিয়েছিলেন উন্নত জীবনের আশায়। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তাকে বেতন ছাড়াই অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। খাবারের নামে দেওয়া হতো পাউরুটি ও বাথরুমের পানি। আশ্রয়ের খোঁজে দূতাবাসে গেলে ২০ হাজার রিয়াল দাবি করা হয়। পরিণতিতে তিনি দেশে ফেরেন। কিন্তু পরিবার ও সমাজের কাছেও তিনি হয়ে উঠেন অবাঞ্ছিত।
আরও পড়ুন
আরেক নির্যাতনের শিকার নারী ফাতেমা (ছদ্মনাম) যশোর সীমান্ত দিয়ে পাচার হওয়ার আগমুহূর্তে পালিয়ে বাঁচলেও, ফিরে পাননি স্বাভাবিক জীবন। দালাল চক্রের অপপ্রচারে তাকে পরিবার ও গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে নারায়ণগঞ্জে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করলেও, স্বামী সাইফুল্লাহ তাকে ব্ল্যাকমেইল ও যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে চার বছরেরও বেশি সময় ধরে শোষণ করে। এখনো সেই চক্র মিথ্যা মামলায় তাকে হয়রানি করছে।
জর্ডানে অভিজ্ঞতা নিতে যাওয়া সীমা আক্তার (ছদ্মনাম) ফিরেও আশ্রয় পাননি নিজের বাড়িতে। মারধর ও অবহেলার শিকার হয়ে একসময় তিনি গার্মেন্টসে কাজ নিয়ে ভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করেন। বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় যেসব খরচ সরকার নির্ধারিতভাবে নিয়োগদাতাদের বহন করার কথা, বাস্তবে তার উল্টোটা ঘটে। নারীরা দালালদের হাত ধরে মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে বিদেশে গিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতনের মুখোমুখি হন।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, মারধরের ফলে অনেক নারী কর্মীর জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সন্তান ধারণের ক্ষমতা হারান তারা। অনেকের ক্ষেত্রে নিয়োগদাতা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন নির্যাতন করেন। এই ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই পরিবারে ফেরার সুযোগ হারান। কেউ কেউ সন্তানসহ ফিরে এলেও সমাজের নির্মমতায় তাদের জীবন রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
এই বিষয়ে ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে ফেরেন, তাদের জন্য পরিবারে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।’ অন্যদিকে আইনজীবী শাহ নাভিলা কাশফি মনে করেন, ‘রাষ্ট্রীয় যন্ত্র যদি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা কোথায় যাবেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘এই অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত সকল পক্ষকে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং নির্যাতিত নারীদের সমাজে পুনর্বাসনে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’