সালেহ উদ্দিন আহমদ
আমাদের জাতীয় চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্য আকঁড়ে ধরে রেখে আমরা এখন প্রবাসী। আমরা যেখানেই যাই, সেখানেই গড়ে তুলি এক খণ্ড বাংলাদেশ।
চার দশক আগে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই। তখন ইন্টারনেট ছিল না, সরাসরি ফোন করার ব্যবস্থাও ছিল না। বাংলাদেশে ফোন করতে হলে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কল বুক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। বহু প্রতীক্ষার পর এক সময় অপারেটরের কণ্ঠে শোনা যেত, ‘বাংলাদেশের লাইন দিচ্ছি, কথা বলুন।’ কিন্তু তখনও মায়ের কণ্ঠস্বর পাওয়া যেত না, শুধু যান্ত্রিক শব্দ। সেই একাকী জীবনে আশার একমাত্র আলো ছিল ডাকপিয়নের হাতে আসা মায়ের চিঠি। হলুদ খামে মোড়া সেই চিঠিগুলোয় ছিল দেশের গন্ধ, মায়ের মমতা, প্রিয়জনের স্মৃতি।
আরও পড়ুন
আজকের দিনে প্রযুক্তির কল্যাণে সেই দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে গেছে। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যখন-তখন দেশের খবর পাওয়া যায়, মায়ের সঙ্গে কথা বলা যায় ভিডিও কলেও। দেশের টিভি অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সংবাদপত্র– সবই পৌঁছে যায় চোখের সামনে। ভ্রমণের খরচও অনেক সহজলভ্য হয়েছে। সেই পুরোনো দিনের মতো আর লটারির খাম খুলে স্বপ্ন দেখি না, বরং এখনকার জীবনটা অনেক বাস্তব ও ভারসাম্যপূর্ণ। প্রবাসে থেকেও নিজেকে আর একেবারে পরবাসী মনে হয় না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা দেশের সঙ্গে গভীর সংযোগ রেখেই বসবাস করেন। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ রাখছেন। বিশ্ব এখন অনেক ছোট হয়ে এসেছে, ভৌগোলিক দূরত্ব আর সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশ এখন প্রবাসীদের অনেক কাছে, মানসিকভাবে আরও কাছের।
প্রবাসেও বাংলাদেশিদের জীবন থেমে নেই। তারা ডাল-ভাত খান, ইলিশ মাছ খুঁজে খুশি হন, রবীন্দ্র-নজরুল সংগীতে মন ভেজান। বাংলা নাটক, সাহিত্যসভা, বইমেলা, পটলাক পার্টি, রাজনৈতিক তৎপরতা– সবই থাকে তাদের জীবনের অংশ। প্রবাসে থেকেও তারা বাংলা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিফলন দেখা যায় তাদের স্লোগান, মিছিল কিংবা নেতাদের আগমনে দেওয়া অভ্যর্থনায়ও।
বাংলাদেশের জিডিপির একটি বড় অংশ আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার আসে বিদেশ থেকে, যা বিদেশি সাহায্যের চেয়েও বহুগুণ বেশি। তবে এ অবদানের বিপরীতে প্রবাসীরা নানাভাবে অবহেলার শিকার। দেশে তাদের পরিবারের প্রতি হয়রানি, চাকরি হারালে কর্মসংস্থানের অনুপস্থিতি, কিংবা দূতাবাস থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার এই প্রবাসীদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব আছে। প্রবাসীদের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে। একজন ক্ষুব্ধ প্রবাসীর চেয়ে একজন খুশি প্রবাসী দেশের জন্য অনেক বেশি মূল্যবান। তাদের জন্য নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সংযুক্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলেই গড়ে উঠবে একটি সত্যিকারের বৈশ্বিক বাংলাদেশ।