চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ৩৭ যুবককে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করছে একটি চক্র। তাদের একটি ঘরে বন্দি করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবার উপজেলার বেলগাছি গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী মাফিয়া সাগরসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
চক্রটি ভুক্তভোগীদের বাবা-মা ও স্বজনদের মোবাইলে ভিডিও কলে রেখে মুক্তিপণ দাবি করছে। তাদের নির্মম নির্যাতনের ভিডিও দেখে স্বজনরা উদ্বিগ্ন।
ভুক্তভোগীদের পরিবারের লোকজন জানান, বেলগাছি গ্রামের জান্টু মেম্বারের ছেলে সাগর দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় থাকেন। সাগরের ভাই জীবন আহম্মেদ এলাকার যুবকদের এ বলে প্রলুব্ধ করেন যে, তার (সাগর) মাধ্যমে ইতালি গেলে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি পাবে সবাই। বিনিময়ে প্রত্যেককে ১৩ লাখ টাকা দিতে হবে। এ টাকার বিনিময়ে তাদের দুবাই থেকে ইতালি পাঠানো হবে। সাগরের চাচা ঠান্ডু, ঠান্ডুর ছেলে জিম ও তার স্ত্রী বেদানা খাতুন এবং বজলুর রহমানের ছেলে সবুজের মাধ্যমে এলাকার ৩৭ জন প্রলোভনে পড়েন।
আরও পড়ুন
চক্রটি হঠাৎ করে ৪-৫ দিন আগে বন্দি যুবকদের পরিবারের কাছে ফোন দিয়ে ২২ লাখ টাকা করে দাবি করে। টাকা না দিলে নির্যাতন করে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়া হয়। নিয়মিত ভিডিও কলে ফোন দিয়ে চক্রটি দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে তাদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য দেখায়। এরপর দাবি করা টাকাও দেখাতে বলে চক্রটি। পরিবারের সদস্যরা নির্যাতনের দৃশ্য দেখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ভুক্তভোগীরা হলেন: আলমডাঙ্গা এলাকার হাউসপুর গ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে মামুনুর রশিদ, খেজুরতলা গ্রামের তামসের আলীর ছেলে মিঠুন, একই গ্রামের রেজাউল হকের ছেলে তুহিন হক, আব্দুল মজিদের ছেলে তিতাস, আজগর আলীর ছেলে জুয়েল রানা, সাজাহান আলীর ছেলে হাসিবুল ইসলাম, তমেজ আলীর ছেলে আরিফুল ইসলাম, হাসান মণ্ডলের ছেলে বকুল হোসেন, শওকত আলীর ছেলে নয়ন হক, ফারুক হোসেনের ছেলে আবু সাঈদ, জমসেদ আলীর ছেলে জুনায়েদ হাসান প্লাবন, আল মামুনের ছেলে আবু জাফর, মহাবুল হোসেনের ছেলে সাগর আলী, মনির উদ্দিন মণ্ডলের ছেলে মিল্টন আলী, অহিদুল ইসলামের ছেলে মোশারফ আলী, নজরুল ইসলামের ছেলে বিপুল হোসেন, নাসির উদ্দিনের ছেলে নিশান মিয়া, আনিছ আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ জাহিদ, আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার গোবিন্দপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের ছেলে সজিব হোসেন, ফজলুর রহমানের ছেলে হৃদয় আহমেদ টিটন, জহুরুল নগর গ্রামের লাল্টু রহমানের ছেলে সবুজ আলী, কাবিলনগর গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে বিপ্লব হোসেন, ঘোলদাড়ি গ্রামের শ্রী চিত্তরঞ্জনের ছেলে শ্রী সনজিত কুমার, কেশবপুর গ্রামের মাহাবুল ইসলামের ছেলে মামুন আলী, সদর উপজেলার মোমিনপুর গ্রামের সমীর আলীর ছেলে তরিকুল ইসলাম প্রমুখ।
জানা যায়, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের ৩৭ যুবক ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে আলমডাঙ্গা বেলগাছি গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী মাফিয়াখ্যাত সাগর ওই যুবকদের নানাভাবে প্রলোভন দেখাতে থাকেন। কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ সুদে টাকা নিয়ে, আর কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিয়ে আপনজনদের বিদেশ পাঠান ২০২৩ সালের শেষের দিকে। দালাল সাগর তাদের লিবিয়া নিয়ে বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। পরিবারের কাছে ইতালি যাওয়ার জন্য আরও টাকা দাবি করে। সেই টাকাও পরিবার পরিশোধ করে।
বিভিন্ন তারিখে নগদ ও ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা করে সবাই পরিশোধ করে। টাকা পেয়ে জীবন গং ভুক্তভোগীদের দুবাই নিয়ে যায়। দুবাই থেকে ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা প্রতারণা করে দুবাই থেকে লিবিয়া নিয়ে যায়। লিবিয়াতে নিয়ে গিয়ে একটি গোপন কক্ষে আটকে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে।
দেশে ভিডিও মোবাইল কলের মাধ্যমে লিবিয়ায় তাদের ওপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের দৃশ্য দেখিয়ে এসব যুবকের স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেনও। টাকা নেয়ার পরও তারা ওই যুবকদের সেখানে আটকে রেখে জনপ্রতি আরও ২২ লাখ টাকা দাবি করছে। এ অবস্থায় ভোক্তভোগী যুবকদের স্বজনরা মোবাইলে এ দৃশ্য দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। তারা না পারছেন টাকা পাঠাতে, না পারছেন সেখান থেকে তাদের মুক্ত করতে। কোনো উপায় না পেয়ে সঠিক পথ খুঁজে পেতে ও বিচারের আশায় যাদবপুর গ্রামের আব্দুস সুবহানের স্ত্রী ছাবিনা খাতুন, খেজুরতলা গ্রামের নাসির উদ্দিনের স্ত্রী সাবানা খাতুন ও জুয়েল আলীর স্ত্রী পলি খাতুন, হাউসপুর গ্রামের আতিয়ার রহমানের ছেলে মাসুদ রানা, খেজুরতলা গ্রামের ওহিদুল ইসলামের স্ত্রী কল্পনা খাতুনসহ বেশ কয়েকটি পরিবার থানা পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
ভুক্তভোগী ৩৭ পরিবারের লোকজন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলামের সঙ্গে তার অফিসে গিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
এ বিষয়ে আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদুর রহমান জানান, সাগর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী বেশ কটি পরিবার আলমডাঙ্গা থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযুক্তরা গা-ঢাকা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।