একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়া আজ পরিণত হয়েছে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের এক অনুকরণীয় মডেলে। মাত্র ৩ লাখ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং এরপর একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপ নেয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মালয়েশিয়া চরম দারিদ্র্য, বৈষম্য ও জাতিগত উত্তেজনার মুখে পড়ে। চীনা ও ভারতীয় অভিবাসীরা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় মুসলমানরা প্রান্তিক হয়ে পড়ে, যা ১৯৬৯ সালের জাতিগত দাঙ্গার জন্ম দেয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার ‘মালয় ক্ষমতায়ন নীতি’ প্রবর্তন করে, যার মাধ্যমে মালয় জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
মালয়েশিয়ার অগ্রযাত্রার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন ডা. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা করে রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ১৯৮১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর রচিত “The Malay Dilemma” বইটি তাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত করে তোলে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথির কঠোর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নেন এবং দক্ষতা ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গঠনের ওপর জোর দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, উন্নয়নের জন্য কেবল আইন যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন সুশৃঙ্খল কর্মপ্রক্রিয়া ও স্বচ্ছতা।
মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া শিল্পায়ন, প্রযুক্তি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করে। বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া হলেও তা স্থানীয় শিল্পের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না করে পরিচালিত হয়। তিনি দেশের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতায় গুরুত্ব দেন এবং বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজস্ব কৌশলে দেশ পরিচালনা করেন। ১৯৮০-এর দশকে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৭১ শতাংশ, তা বর্তমানে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, বিশেষত তেল ও গ্যাস উত্তোলনের মাধ্যমে মালয়েশিয়া বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও একটি শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করে।
আরও পড়ুন
শিক্ষা খাত ছিল মাহাথিরের অন্যতম অগ্রাধিকারের বিষয়। তিনি জাপানি শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে মালয়েশিয়ার শিক্ষানীতিকে জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে একীভূত করেন। আধুনিক, শিল্পনির্ভর ও প্রযুক্তিকেন্দ্রিক মানবসম্পদ গড়ে তুলতে তিনি জাতীয় বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বরাদ্দ করেন। এ উদ্যোগ দেশটির শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে, যা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক থেকে মালয়েশিয়া একটি ভারসাম্যপূর্ণ মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হয়েও সেখানে ধর্মীয় উগ্রতার পরিবর্তে উদারনৈতিক ও সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। ইসলামিক পার্টি (PAS) রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ হয়েও কখনো ক্ষমতায়, কখনো বিরোধী ভূমিকায় থেকে শরিয়া আইনের সীমিত প্রয়োগে যুক্ত হয়েছে। মালয়েশিয়ার সরকার মধ্যপ্রাচ্য ফেরত ইসলামপন্থীদের শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করেছে এবং রাজনীতিতে ইসলামকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যাতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত না হয়।
মোটের ওপর, মালয়েশিয়ার উন্নয়ন ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে, সুশাসন, দূরদর্শী নেতৃত্ব, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং শিক্ষা ও অর্থনীতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি পিছিয়ে পড়া দেশও বিশ্বপরিসরে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।